বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:২১ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্কঃ বরিশাল সিটি নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া খোকন সেরনিয়াবাতকে সামনে রেখে প্রতিপক্ষ দমনের মিশনে নেমেছেন মেয়র সাদিকবিরোধীরা। ইতোমধ্যে সাদিককে বরিশালে ফিরতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। দখল করা হয়েছে সাদিকপন্থিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভোলা-বরিশাল স্পিডবোট ঘাট আর রুপাতলী বাস টার্মিনালে থাকা শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়। সোমবার তালা ভেঙে দখলে নেওয়া হয়েছে বিএম কলেজ ছাত্র সংসদ ‘বাকসু’র ভবন।
পরিস্থিতি এমন যে একটি পক্ষ যেন নৌকার প্রচারণার চেয়েও বেশি মনোযোগী মাঠ দখলে। আর এসব ক্ষেত্রে সরাসরি ব্যবহার হচ্ছে খোকন সেরনিয়াবাতের নাম। চলমান এই পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক বলছেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। দলেও বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা। অনেকটাই মুখোমুখি এখন মেয়র সাদিক অনুসারী ও তার বিরোধী পক্ষ। স্পষ্ট এই বিভাজন দলের প্রার্থীকে চরম বেকায়দায় ফেলবে বলে মনে করছেন তারা।
মেয়র সাদিকের মনোনয়ন না পাওয়া আর খোকন সেরনিয়াবাতকে নৌকার কান্ডারি করার পর থেকেই দ্রুত বদলাতে শুরু করে বরিশালের আওয়ামী রাজনীতির প্রেক্ষাপট। উত্থান ঘটে ৯ বছরেরও বেশি সময় দলে কোণঠাসা হয়ে থাকা সাবেক মেয়র হিরণ অনুসারীদের। যদিও হিরণপত্নী সাবেক এমপি জেবুন্নেসা আফরোজা রয়ে যান সাদিক শিবিরে। এদিকে মনোনয়ন ঘোষণার পর চুপচাপ থাকলেও ধীরে ধীরে মাঠে নামতে শুরু করেন সাদিক অনুসারীরা।
তখন থেকেই নগরে শুরু হয় দুপক্ষের সংঘাত। মেয়র সাদিক কিংবা তার অনুসারীদের বরিশালে আসতে না দেওয়ার ঘোষণা দেন খোকন অনুসারীরা। নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন বলেন, ‘নৌকা যাতে না জেতে, সেজন্যে নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে মেয়র সাদিক ও তার অনুসারীরা। সাড়ে ৪ বছর বরিশালে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল তারা। এ অবস্থায় তিনি (সাদিক) বরিশালে এলে একদিকে যেমন নৌকার ক্ষতি করবে, তেমনই ভয় পাবে সাধারণ মানুষ। সেক্ষেত্রে ভোট হারাবে নৌকা। তাই আমরা চাই না তারা আসুক। তারপরও যদি আসার চেষ্টা হয় তবে তা প্রতিহত করা হবে।’
খোকন শিবিরের এসব অভিযোগের মধ্যেই ঘটে নৌকার প্রচারকর্মীদের ওপর দফায় দফায় হামলার ঘটনা। এজন্য সরাসরি দায়ী করা হয় সাদিক অনুসারীদের। হামলার ঘটনায় পৃথক অভিযোগ দায়ের হয় নগরের বিভিন্ন থানায়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে জেলে আছেন মহানগর ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক আহ্বায়ক রইস আহম্মেদ মান্নাসহ সাদিক অনুসারী ১৫ নেতাকর্মী। চলমান এসব রাজনৈতিক টানাপোড়েনে এখন পর্যন্ত নৌকার পক্ষে মাঠে নামেননি সাদিক অনুসারীরা। খোকন অনুসারীরাও চাইছেন না যে তারা মাঠে নামুক। সাদিক অনুসারী কেউ মাঠে নামলে ভোট কমবে-এমনটাই বলছেন তারা।
নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য বিএম কলেজ কর্মপরিষদের সাবেক ভিপি মঈন তুষার বলেন, ‘দল নয়, এরা সাদিকপন্থি। এদের দিয়েই গত সাড়ে ৪ বছর নগরে নানা অপকর্ম করিয়েছেন সাদিক। এরা মাঠে নামলে ক্ষতি হবে নৌকার। বরিশালের মানুষ পরিবর্তন চায়। দলমতনির্বিশেষে তাই সবাই এখন নৌকার পক্ষে। মান্না মার্কা নেতারা মাঠে নামলে সেই ঐক্য আর থাকবে না। সাধারণ ভোটাররাও পড়বে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে।’
মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা অসীম দেওয়ান বলেন, ‘তারা তো (সাদিক এবং তার অনুসারী) নৌকার পক্ষে কাজ করবে না। এই যে দেখুন, পরপর তিনবার হামলা হলো নৌকার কর্মীদের ওপর। দলকে ভালোবাসলে কি তারা এভাবে হামলা করতে পারত? যে কোনো মূল্যে মেয়র সাদিকের বরিশালে আসা প্রতিহত করব আমরা। কেননা তিনি বরিশালে এলে নৌকাকে হারানোর মিশন নিয়েই আসবেন।’
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রবীণ নেতা বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নৌকার বিজয় নয়, দখল আর প্রতিপক্ষ দমনের প্রতিযোগিতা চলছে। অবৈধ আয়ের খনিগুলো সাদিক অনুসারীদের হাত থেকে নিজেদের হাতে নেওয়ার চেষ্টায় আছে একটি পক্ষ। আরেক পক্ষ চাইছে ৯ বছরের কোণঠাসা পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে রাজনীতির মাঠের দখল নিতে। এসব ক্ষেত্রে তারা নিজেদের প্রচার করছে খোকন সেরনিয়াবাতের কর্মী হিসাবে। মেয়র সাদিকের সময়ে একা সাদিকই ছিলেন একনায়কতন্ত্রের কেন্দ্রে। আর এখন তো দেখছি খোকন সেরনিয়াবাতকে ঘিরে অনেক নব্য সাদিকের ভিড়। এই যে দেখুন, সামান্য হাতাহাতি, মারামারি হলেও প্রচার করা হচ্ছে নৌকার সমর্থকদের ওপর হামলা বলে।
সোমবার রাতে নৌকার প্রধান নির্বাচনি কার্যালয়ের সামনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই দল শিক্ষার্থীর মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হাতাহাতি-মারামারি হলো, সেখানেও বলা হচ্ছে নৌকার কর্মীদের ওপর হামলা। বাকসু ভবন দখল, শ্রমিক ইউনিয়নের অফিস দখল, স্পিডবোট ঘাট দখল-সব ক্ষেত্রেই বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে সাদিকের বিরুদ্ধে। নিজেদের খোকন সেরনিয়াবাদের কর্মী হিসাবে পরিচয় দিচ্ছে এরা। এভাবে চলতে থাকলে তো ভোটের মাঠে ভুল বার্তা যাবে। নৌকার কর্মীরা পথেঘাটে মার খাচ্ছে প্রচার হওয়াটা কি ভালো হচ্ছে? দখল আর প্রতিপক্ষ দমনের টার্গেটে ব্যস্ত থাকায় এই বিষয়গুলো হয়তো খেয়ালই করছেন না খোকন সেরনিয়াবাতের অনুসারীরা।’
এদিকে খোকন অনুসারীদের করা নানা অভিযোগকে দলে ভাঙন সৃষ্টি ও নৌকার পরাজয় ত্বরান্বিত করার চেষ্টা আখ্যা দিয়ে মেয়র সাদিক অনুসারী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে রইস আহম্মেদ মান্নাকে। কিন্তু সেই অভিযোগ সত্য কি না, তা কি একবারও খতিয়ে দেখা হয়েছে? গ্রেফতার হওয়ার আগে মান্না বারবার বলেছে যে গত ৫-৭ দিন সে সিসি ক্যামেরার আওতায় ছিল। গ্রেফতার করার আগে কি উচিত ছিল না তার বক্তব্য যাচাই করা? নৌকার জন্য আমরাও কাজ করছি। কিন্তু যেভাবে দলে বিভাজন করা হচ্ছে, তাতে আমাদেরই যে ক্ষতি হচ্ছে, তা কি তারা বোঝেন না?’
মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল বলেন, ‘আমাদের নেতা মেয়র সাদিকের নির্দেশে নৌকার পক্ষে কাজ করছি। নগরের ৩০ ওয়ার্ডের সভাপতি-সম্পাদকসহ সবাই মাঠে আছে। কিন্তু যেভাবে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, তাতে দল ও নৌকার ক্ষতি ছাড়া কিছুই হচ্ছে না।’
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস এমপি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলে টুকটাক জটিলতা থাকতেই পারে। এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। দল, প্রার্থী ও নৌকা প্রশ্নে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ।’
সূত্রঃ যুগান্তর